স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কৃষি-কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে ৯৯ শতাংশের জন্য বাজেট প্রণয়ন করুন
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সভাপতিত্বে আজ ৯ জুন, ২০২০ সভাপতিমন্ডলীর এক টেলিমিটিং অনুষ্ঠিত হয়। টেলিমিটিংয়ে অংশ নেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোহাম্মদ শাহআলম, সহকারী সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাজ্জাদ জহির চন্দন, প্রেসিডিয়াম সদস্য লক্ষী চক্রবর্তী, রফিকুজ্জামান লায়েক, মিহির ঘোষ, অনিরুদ্ধ দাশ অঞ্জন, আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন। সভায় ১১ জুন জাতীয় সংসদে আগামী অর্থ বছরের জন্য ঘোষিতব্য বাজেটকে করোনা মহাবিপর্যয়কালে বিশেষ বিবেচনার বাজেট আখ্যায়িত করে এর অগ্রাধিকার নির্ণয়ের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সভার প্রস্তাবে বলা হয় আগামী বাজেট হতে হবে মানুষ বাঁচানোর বাজেট। সভার প্রস্তাবে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কৃষি-কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে ৯৯% এর জন্য বাজেট প্রণয়ন করুন।
সভার প্রস্তাবনায় বলা হয়, প্রশাসনিক ক্ষেত্রসহ সরকারের রাজস্ব খাতে ব্যয় নাটকীয় ভাবে কমিয়ে আনতে হবে এর জন্য নীচের ব্যবস্থাগুলো জরুরী ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে।
ক) বাজেটের অর্থ সংস্থানের প্রধান উৎসহ লোভ্যাট, ডিউটি, বিক্রয় কর ইত্যাদি পরোক্ষ কর। আর্থিক সক্ষমতা নির্বিশেষে ধনী-দরিদ্র সবার কাছ থেকে সমান হারে তা আদায় করা হয়। এ ধরনের চরম বৈষম্যমূলক করনীতি আমূল বদলে দিয়ে মানুষের আর্থিক সক্ষমতার অনুপাতে এবং ক্রমবর্ধমান হারে করারোপ করে বাজেটের অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা ও কাঠামো চালু করতে হবে। অর্থ সংস্থানের জন্য পরোক্ষ করের বদলে প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দিতে হবে।
খ) বাজেটের পরিমাণও বাড়াতে হবে। এ জন্য খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায়, অপ্রদর্শিত কালো টাকা ও বিদেশে পাচারকৃত কোটি কোটি টাকা দেশে ফেরত আনা ও বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এসব টাকা রাষ্ট্রীয় ভাবে বিনিয়োগ করে প্রতিটি মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও তাদের প্রকৃত আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে।
গ) বাজেটের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয়, সিস্টেম লস, বিলাসিতা ইত্যাদি রোধ করে মিতব্যয়িতার নীতির প্রতিফলন ঘটাতে হবে। প্রশাসনিক ব্যয় কমাতে হবে। সব ধরনের দুর্নীতি-অনিয়ম কঠোর ভাবে দমন ও নিবৃত্ত করতে হবে।
ঘ) অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ হ্রাস করতে হবে। প্রতিরক্ষাখাতে রাদ্দের পরিমাণ প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও যুক্তিসঙ্গত মাত্রায় কমিয়ে আনতে হবে। মাথাভারী প্রশাসনযন্ত্রকে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে, যথা সম্ভব সরকারী ক্রয় কমাতে হবে। বড় বড় প্রজেক্ট গ্রহণ বিপদোত্তরীণ কালে স্থগিত রাখতে হবে। সর্বনিম্ন-সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দিনগুলোর মতো ১:৬ করতে হবে।
সভার প্রস্তাবে আরো বলা হয়, উপরে বর্ণিত উপায়ে রাজস্ব ব্যয়কে যথা সম্ভব কমিয়ে রেখে বাজেটের উন্নয়ন-বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সেই মূল অংশকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করে খরচ করতে হবে।
১) বাজেটের প্রথম এক-তৃতীয়াংশ খরচ করতে হবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা-গবেষনা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, পরিবেশ, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি খাত তথা সামাজিক কল্যাণ ও সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ খাতে। আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে কমপক্ষে বাজেটের ১২ শতাংশ ও শিক্ষা-গবেষনা খাতে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। গ্রাম ও শহরের অভাবগ্রস্থ মানুষসহ সাধারণ নাগরিকদের জন্য স্থায়ী রেশনিং ব্যবস্থা চালু, শক্তিশালী গণবণ্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, দুর্যোগ কালীন জরুরি ব্যয় নির্বাহ ইত্যাদির জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে।
২) বাজেটের দ্বিতীয় এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় করতে হবে কৃষি খাত, শিল্প খাত, স্বনিয়োজিত বিনিয়োগ, আত্মকর্মসংস্থান, বেকারত্ব দূরীকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে। বরাদ্দকৃত এসব অর্থের ৭৫ শতাংশ যেনসরাসরি কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, গরিব-মধ্যবিত্ত জনগণের কাছে পৌঁছায় এবং এভাবে যেন অগণিত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার বিপুলভাবে প্রসারিত ও সচল হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
৩) বাজেটের শেষ এক-তৃতীয়াংশ নির্ধারিত রাখতে হবে দেশের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের জন্য। নদী খনন, রাস্তা ঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, নৌ-রেল-সড়কপথে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, শ্রমিকদের জন্য কলোনি, বাস্তুহীনদের জন্য বসত বাড়ি নির্মাণ ইত্যাদির জন্য এই অর্থ ব্যয় করতে হবে।
প্রস্তাবে বলা হয়, করোনা মহাবিপর্যয় গোটা পৃথিবীর ক্ষেত্রে আবার প্রমাণ করে দিয়েছে নিওলিবারেল মুক্ত বাজার অর্থনীতি আপমোর জনতার স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। আমাদের দেশে এ-যাবৎকালের প্রায় সবটা সময় জুড়ে জাতীয় বাজেট প্রণীত হয়েছে ৯৯ শতাংশকে বঞ্চিত করে ১ শতাংশের জন্য। সেই যুগের অবসান ঘটানোর সময় এসে গেছে। করোনা মহামারীর মহাদুর্যোগের মাঝে দাঁড়িয়ে আজ আর সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। কারণ করোনা মহাবিপর্যয় দেখিয়ে দিয়েছে, বাঁচতে হলে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি যে নীতি-দর্শনের আলোকে এতদিন বাজেট প্রণীত হয়েছে, তা আমূল বদলে দেয়া ব্যতিত ভিন্ন কোন পথ নাই। বাঁচার জন্যই ৯৯ শতাংশের স্বার্থের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে এবং শুরু করতে হবে এ বাজেট থেকেই এটাই আমাদের সুস্পষ্ট দাবি।
৯ জুন ২০২০
249 total views, 1 views today