গল্পটা ছোটবেলায় কোন এক মুরুব্বীর মুখে শুনেছি।
কাহিনীটা মোটামুটি এরকম । তখনকার সময় মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশারা সারা বিশ্ব রাজত্ব করত । ঠিক সে সময় আরবের এক প্রভাবশালী বাদশা ছিলেন । একদিন বাদশা তার নতুন রানী , কিছু সঙ্গী-সাথী এবং নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে বাজারে গিয়েছিলেন দাস-দাসী খরিদ করার জন্য । তখনকার সময় বাজারে দাস-দাসী বিক্রি করা হতো বর্তমান সময়ে গরু ছাগলের বাজারের মত । যার প্রয়োজন হতো সে বাজারে গিয়ে দাস দাসী কিনে নিত তার পছন্দের মত । নতুন রানী বাজারে গিয়ে দেখতে ছিলেন বাজারে অনেক ক্রীতদাস আছে । রাজা রানী কে বলল তুমি তোমার পছন্দমত ক্রীতদাস পছন্দ করে নাও । রানি তখন বাজারে হেঁটে হেঁটে ক্রীতদাস পছন্দ করতে গিয়ে অহংকারী রানী কোন এক ক্রীতদাসের সামনে গিয়ে তার মুখে একটু থুতু নিক্ষেপ করলো। তখন দেখা যাচ্ছে ঐ ক্রীতদাস রানী কে খুশি করার জন্য বললেন রানীমা আপনার থুতু খুব মিষ্টি । এভাবে রানী ক্রীতদাসের সামনে গিয়ে কারো গালে একটা থাপ্পর মারে , কারোর গায়ে লাথি মারে , কারোর গায়ে চাবুক মারে বা কাউকে গালি দেয়। এতে ক্রীতদাস দাসীরাও তাদের পারফরম্যান্স শো করার জন্য বলতে লাগলো রানীমা এর হাত কত নরম , রানীমায়ের পা কত মোলায়েম , রানী মায়ের গালি কত সুমধুর । যেন তারা এক একটা পারফেক্ট ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসী ।
এভাবে ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসীদের যোগ্যতা পরীক্ষা করতে গিয়ে এক সময় কোন এক ব্যতিক্রমী ক্রীতদাসের মুখে থুতু মারে । তখন সেই ক্রীতদাস খুব রাগান্বিত হয়ে উল্টা রানিমার মুখে থুতু মেরে দিয়ে রানীকে বকাঝকা করতে লাগলো । ঘটনায় সবার হতভম্ব কারণ কেউ ভাবতে পারেনি যে ক্রীতদাসটি এভাবে রিয়েক্ট করবে রানী মার সাথে । রানিমা তো রেগে অগ্নিমূর্তি আকার ধারণ করল এবং সাথে সাথে রাজার প্রহরীরা যারা ঘটনাস্থলে ছিল তারা তাদের তলোয়ারকে খাপমুক্ত করল ক্রীতদাসের গর্দান কেটে নেওয়ার জন্য । ক্রীতদাসের এত বড় সাহস রানী মার সাথে এমন আচরণ করবে? রানিমার প্রতিবাদ করবে? তাকে তো জীবিত রাখা যায়না ।
বিচক্ষণ রাজা দূর থেকে সমস্ত ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলো এবং সাথে সাথে রাজার প্রহরীদেরকে ডেকে থামালো যাতে তারা যেন কিছুতে সেই প্রতিবাদী ক্রীতদাসের গর্দান কেটে না নিতে পারে । রাজা সে ক্রীতদাসের সামনে এসে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল এবং তাকে পর্যবেক্ষণ করল। এরপর রাজা সেই ক্রীতদাসকে সম্মান দেখাল এবং তাকে মুক্ত করে দিল । রাজার এমন আচরণে সবাই তো হতবাক এবং সবার একটাই প্রশ্ন হে মহামান্য বাদশা আপনি কেন ওই বেয়াদব ক্রীতদাসকে মুক্ত করতে গেলেন যে ক্রীতদাস রানীর মুখের উপর কথা বলে, রানীর মুখের উপরে থুতু মারে ? আমরা সবাই ঐ বেয়াদব ক্রীতদাস এর গর্দান কেটে নিব ।
তখন রাজা ক্রীতদাস কে মুক্ত করে দিয়ে সবাইকে বললো , এই লোকের জন্ম দাসত্ব করার জন্য হয়নি । এই লোকের জন্ম হয়েছে দেশকে এবং জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য । কারণ সে তোষামোদ করা পছন্দ করে না এবং অন্যায় কে প্রশ্রয় দেয় না । সে স্বাধীনচেতার মানুষ । জাতি গঠনের জন্য দেশ গঠনের জন্য এ ধরনের লোকের প্রয়োজন আছে , তাই আমি তাকে মুক্ত করে দিলাম দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে ।
এখন আমাদের জন্য এই ধরনের একজন বিচক্ষণ রাজা প্রয়োজন যে অন্তত বুঝতে পারে কে ক্রীতদাস আর কে দেশপ্রমিক । কে তোষামোদকারী আর কে যোগ্য ব্যক্তি এবংস্পষ্টবাদী । এই পার্থক্যটুকু বুঝার জন্য যার ন্যূনতম জ্ঞান নাই তাকে অন্তত রাজা হিসাবে বা শাসক হিসেবে মানায় না , এবং এ ধরনের রাজা বা শাসক থেকে জাতি কিছু আশা করতে পারেনা।
তাই জাতির কাছে আমার একটি ছোট্ট প্রশ্ন? তৎকালীন আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা বর্বর যুগেও যদি ঐ বাদশার মত বিচক্ষণ ব্যক্তি থেকে থাকে তাহলে বর্তমানে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পন করে কিভাবে অজ্ঞতা, তোষামদী আর পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে গেলাম? এই ব্যর্থতা কার? শাসকের না জনতার?
———শেখ মিসকিন, মেহেরপুর
651 total views, 1 views today