ঈদ স্মৃতি
আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে, সময়টা ২০১০। ২০১০ এর পবিত্র ঈদুল আজহার কথা এখনও আমার স্মৃতিতে আছে। ঈদের আগের দিনগুলোতে কী কী করেছিলাম সব মনে নেই, কিন্তু ঈদের দিন কী ঘটেছিল সেটা খুব ভালোভাবেই মনে আছে। যথারীতি ঈদের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়ে নিলাম। বাড়ির আমরা সব পিচ্চিরা, বাবা, দাদা, চাচারা দল বেঁধে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। নামাজ শেষে সবাই সবার সাথে কোলাকুলি করে বাসায় ফিরলাম। এরপর গরু জবাই করার তোড়জোড় শুরু হলো। মোল্লা এলেন, আল্লাহর নামে গরু জবাই করা হলো। আমরা সমস্বরে আল্লাহু আকবর বলে উঠলাম।
বাড়ির সবাই মাংস কাটাকাটিতে ব্যস্ত। আমরা পিচ্চিরা খেলছি, সেমাই খাচ্ছি। মাংস কাটাকাটি শেষ হতে প্রায় বিকাল হয়ে গেল। ইতোমধ্যে গরীবদের মাঝে একভাগ বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে; আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিলানো বাকি আছে। কে কোন আত্মীয়ের বাসায় মাংস পৌঁছে দেবে, সেটা ঠিক করা হলো। আমার দায়িত্ব পড়লো আমি ফুপির বাসায় মাংস পৌঁছে দেবো। কারণ ফুপির বাসা আমাদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়, জমির আইল ধরে হেঁটে গেলে ১০-১৫ মিনিটের পথ। রিক্সায় গেলে ১০ টাকা ভাড়া। আর তাছাড়া ফুপির বাসায় প্রায় সময় আমি একা একাই যাই। আমিও খুশি মনে রাজী হয়ে গেলাম। কারণ ফুপির বাসায় গেলে ফুপা অবশ্যই সালামি দেবে!
আমি রওনা হলাম। আমাকে ২০ টাকা ভাড়া দেওয়া হলো, রিকশা দিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি বুদ্ধি করে হেঁটেই রওনা হলাম! তাহলে ২০ টাকা আমার হয়ে যাবে! তবে কিছুক্ষণ হাঁটার পর বুঝতে পারলাম, বেশি কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কারণ আগে যখন হেঁটে যেতাম, তখন খালি হাতে তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে চলে যেতাম। কিন্তু এখন আমার হাতে ভারি একটা ব্যাগ! কিছুক্ষণ জিরিয়ে জিরিয়ে চলতে শুরু করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরে দেখলাম রাস্তার পাশে এক বুড়ো লোক বসে আছেন। অনেক বুড়ো, আমার দাদার চেয়েও। দাঁড়ি, চুল সাদা।
আমি কিছুটা ভয় পেলাম। কারণ গল্পের বইতে পড়েছি, জিন-ভুতেরা নির্জন রাস্তার পাশে মানুষের বেশ ধরে বসে থাকে! কাছে গেলেই ঘাড় মটকে দেয়! আশেপাশে কোনো মানুষজনও নেই, আমি কিছুটা দূর থেকে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করলাম। কিছুক্ষণ পর ধীর পায়ে বৃদ্ধ লোকটির কাছে এগুলাম। লোকটি আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। লোকটি ঘামে ভেজা, একটা ময়লা কাপড় পরনে, কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। আমি বললাম, “আপনি কে? এখানে একা বসে আছেন কেন? আপনি ঈদ করেন নাই?”
লোকটি একটা সাদা ব্যাগ দেখিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে কী যেন বলার চেষ্টা করলেন। পুরোপুরি বুঝিনি, তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, তিনি খুব গরীব। মাংস সংগ্রহের জন্য বের হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় বাড়ি বাড়ি যেতে পারেননি। তাই মাংস সংগ্রহ করতে পারেননি।
আমি ব্যাগটি হাতে নিয়ে দেখলাম সেখানে খুব অল্প মাংস আছে, এটা দিয়ে একজনেরও হবে না। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পরক্ষণেই আমার মনে হলো, আমার কাছে তো অনেকগুলো মাংস আছে, সেগুলো দিয়ে দিলেই হয়। কিন্তু আবার মনে হলো, এগুলোতো ফুপির বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে।
আমি বৃদ্ধ লোকটিকে বললাম, “আমার কাছে অনেকগুলো মাংস আছে। আপনি সেগুলো নিয়ে যান।” বৃদ্ধ লোকটি বোধহয় কিছুটা অবাক হলেন, তিনি মাংসগুলো নিতে ইতস্ততবোধ করছিলেন। আমি বললাম, “আপনি এইগুলো নিয়ে যান। আমার বাড়িতে আরও আছে।” লোকটি আমার মাথায়, আমার কাঁধে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। মনে মনে ভাবলাম, দোয়া করছেন হয়তো।
মাংস-তো দিয়ে দিলাম, কিন্তু এখন আরেক দুশ্চিন্তায় পড়লাম। এখন কী করব? এখন মাঝপথে আছি, ফুপির বাসায় যাব নাকি আমার বাসায় ফিরে যাব! ফুপির বাসায় খালি হতে গিয়ে কী করব! তাই আমার বাড়ির পথেই যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু মাথায় তখন নানা প্রশ্ন। বাড়িতে গিয়ে কী বলবো? বকা দিবে না তো? আমাকে ভুল বুঝবে না তো? এমন নানা প্রশ্ন চিন্তা করতে করতে কিছুটা ভয় নিয়ে বাড়িতে এসে পৌঁছালাম। সবার আগে মা দেখলেন আমাকে। বললেন, “কী রে গেলি কখন, আর আসলি কখন? কিছু না খেয়েই চলে এসেছিস?”
আমি সব খুলে বললাম ঘটনা। মা, বাবা আর দাদাকে ডেকে আনলেন। তাঁদের কাছে বললেন ঘটনা। তারা সবাই একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করলেন। আমি ভাবলাম, আমাকে হয়তো এখন উত্তম-মধ্যম দেওয়া হবে। কিন্তু না, আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা বলে উঠলেন, “শাবাশ, ভালো করেছিস। তারা গরিব মানুষ, গরিব মানুষদের জন্য আমাদেরই কিছু করতে হয়। তাদের কাছে-তো টাকা নেই, আমরা তাদেরকে মাংস না দিলে তার মাংস খাবে কী করে।”
আর দাদা আমাকে কাছে টেনে নিলেন। বললেন, “এই যে আমরা গরু জবাই দিলাম, এটাকে কী বলে?”
আমি বললাম, “ঈদ বলে।”
দাদা বললেন, “না, এটা হলো কুরবানী। কুরবানী মানে কী?” আমি দাদাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “কুরবানী মানে কী?” দাদা বললেন, “কুরবানী মানে হলো ত্যাগ করা, বিলিয়ে দেওয়া। তুই যেটা করেছিস সেটা হলো বিলিয়ে দেওয়া। কুরবানীর আসল উদ্দেশ্য মাংস খাওয়া নয়, বিলিয়ে দেওয়া।”
কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ঘটনাটি পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে গেল। সবাই আমার প্রশংসা শুরু করল, আমি সবার চোখে হিরো হয়ে গেলাম! আমাকে আরেকটি ব্যাগ দেওয়া হলো, ফুপির বাড়িতে আবার যাওয়ার জন্য। বের হওয়ার সময় দাদা বলে দিলেন, “যাওয়ার পথে যদি আবার এমন কাউকে পাস, তাহলে এগুলোও দিয়ে দিবি!”
যাই হোক, এই যাত্রায় তেমন কাউকে পাইনি। এবার রিক্সা দিয়ে সোজা ফুপির বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। দ্বিগুণ সেলামি পেলাম এবার। একটা ঈদের সেলামি; আরেকটা বৃদ্ধ লোককে মাংস বিলিয়ে দিয়েছি, সেটার জন্য বকশিশ!
শিক্ষার্থী,
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল: 01954888235
ইমেইল: jahid.duir@gmail.com
744 total views, 1 views today