ঈদুল আযহা মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম।বাংলাদেশে এটি কুরবানীর ঈদ, বাকরা ইদ নামে পরিচিত।প্রতি বছরের ন্যায় মহাধুমধাম ও আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে ইদুল আযহা উদযাপনের উদ্দেশ্য থাকলেও করোনা ভাইরাস (COVID 19) তার প্রধান অন্তরায়। ইতিমধ্যে সরকার ঈদুল আযহা যথাযথভাবে পালন করার উদ্দেশ্যে যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন।
ঈদ ও আযহা দুটিই আরবী শব্দ। ইদ এর অর্থ উৎসব বা আনন্দ। আযহার অর্থ কুরবানী বা উৎসর্গ করা। হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহ তা’লার আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে তাঁর (হযরত ইসমাঈলের) পূর্ণ সম্মতিতে কুরবানী করতে উদ্যত হন । মক্কার নিকটস্থ ‘‘মীনা’’ নামক স্থানে এ মহান কুরবানীর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাঁর ঐকান্তিক নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে তাঁর পুত্রের স্থলে একটি পশু কুরবানী করতে আদেশ দেন। আল্লাহর প্রতি অবিচল আনুগত্য ও নজিরবিহীন নিষ্ঠার এ মহান ঘটনা অনুক্রমে আজও মীনায় এবং মুসলিম জগতের সর্বত্র আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে পশু কুরবানীর রীতি প্রচলিত রয়েছে।
উৎসর্গকৃত পশু, যা’ এক আল্লাহর উদ্দেশ্যে যাব্হ করা হয়, আত্মীয়-স্বজন বিশেষত দুঃস্থ দরিদ্রজনের মধ্যে যা’ বিতরণ করে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তাঁর সান্নিধ্য লাভ করার চেষ্টা চালান হয়, সে সার্থক প্রচেষ্টার যে আত্মিক আনন্দ তাই ঈদুল আযহা নামে অভিহিত হয়। এ দিনে মীনায় হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর অনুপম কুরবানীর অনুসরণে কেবল হাজীদের জন্য নয়, বরং মুসলিম জগতের সর্বত্র সকল সক্ষম মুসলমানদের জন্য এ কুরবানী করা ওয়াজিব ( সুন্নাঃ মুআক্কাদা)।
ঈদুল আযহা ১০ই যু’ল-হিজ্জা, যে দিন পবিত্র হজ্জব্রত পালনকালে হাজীরা মীনা প্রান্তরে কুরবানী করেন এবং তৎপরবর্তী দুই দিনে, মতান্তরে তিন দিনও (আয়্যাম-আল-তাশরীকে) অনুষ্ঠিত হয়।
কুরবানীর পশু নির্ধারিত বয়সের হতে হবে ও কতকগুলি দৈহিক ত্রুটি (কানা, খোঁড়া, কান-কাটা, শিং-ভাঙ্গা, ইত্যাদি) থেকে মুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ঈদের নামাযের পর থেকে কুরবানীর সময় আরম্ভ হয়। পরবর্তী দুই দিন (মতান্তরে তিন দিন) স্থায়ী থাকে এবং শেষ দিনের সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়।
উট, গরু, মহিষ অনধিক সাত জনের পক্ষে এবং মেষ, ছাগল, দুম্বা শুধু একজনের পক্ষে কুরবানী দেওয়া জায়েয। বাংলাদেশে প্রধানত গরু, ছাগল ও মহিষ কুরবানী দেওয়া হয়। কখনও কখনও আমদানীকৃত স্বল্পসংখ্যক উটও কুরবানী দেওয়া হয়।
যে ব্যক্তি কুরবানী করেন তাঁর নিজেই যাবহ করা সুন্নাহ্। তাঁর পক্ষে অন্য কেহও যাব্হ করতে পারে। যাব্হ করার সময় সাধারণত পড়া হয় পবিত্র কুরআনের দুটি আয়াত- সূরা আনআম-এর ৮০ নম্বর এবং ১৬৩ নম্বর আয়াত। প্রথমটির অর্থ হলঃ ‘‘আমি আমার মুখ করিলাম যিনি আকাশমন্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহার প্রতি একনিষ্ঠভাবে এবং আমি মুশরিক নই।’’ দ্বিতীয়টির অর্থ হলঃ ‘‘অবশ্যই আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ, সবই আল্লাহর জন্য যিনি নিখিল বিশ্বের প্রতিপালক, তাঁহার কোনো শরীক নাই।’’ তারপর সাধারণত বলা হয়, ‘‘হে আল্লাহ এ পশু তুমিই দিয়াছ এবং তোমারই জন্য কুরবানী করিতেছি, সুতরাং তুমি ইহা কবুল কর’’, ইত্যাদি। তারপর ‘‘বিছমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’’ বলে যাব্হ করা হয়। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, ‘‘এই কুরবানীর রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, ইহার গোশ্তও না, বরং তাঁহার কাছে পৌঁছায় কেবল তোমাদের তাক্ওয়া’’ (২২ঃ৩৭)। জাহিলিয়্যার যুগে প্রতিমার গায়ে বলির রক্ত-মাখানো হতো এবং গোশ্ত প্রতিমার প্রসাদরূপে বিতরণ করা হতো। ক্ষেত্রবিশেষে নরবলি দেওয়ারও প্রথা ছিল। কুরবানী নরবলির বীভৎস প্রথা চিরতরে বিলুপ্ত করে এবং বলি পশুর রক্ত-মাখানো ও প্রতিমার প্রসাদরূপে বিতরণের প্রথারও মূলোচ্ছেদ করল। একই সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল যে, তাক্ওয়ার চূড়ান্ত অর্থ হলো, প্রয়োজন হলে একজন মু’মিন তাঁর সবকিছু, এমন কি নিজের জীবনটিও, আল্লাহর নামে কুরবানী করতে সর্বদায় প্রস্ত্তত। কারণ ‘‘আল্লাহ মু’মিনের জান-মাল ক্রয় করিয়াছেন জান্নাতের বদলে’’ (৯ঃ১০০)। এ জন্যই কুরআন শরীফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছেঃ ‘‘অনন্তর তোমার প্রতিপালক প্রভুর জন্য নামায পড় এবং কুরবানী কর’’ (১০৮ঃ২)। হাদীস শরীফে এর সুস্পষ্ট বিধান বিদ্যমান।
কুরবানীর পর প্রাপ্ত গোশ্তের তিন ভাগের এক ভাগ মালিক, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বাকি এক ভাগ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এতে দরিদ্রদের প্রতি ধনীদের দায়িত্ব পালনের একটি সুযোগ ঘটে এবং একই সঙ্গে ধনী দরিদ্রের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। কুরবানীকৃত পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করার বা অন্যকে দান করার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু চামড়া, গোশ্ত, হাড্ডি, চর্বি অর্থাৎ নিজ কুরবানীর কোনো কিছু বিক্রী করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ ভোগ করার জাইয নয় (হিদায়া, আলমগীরী, শামী)। কুরবানীর পশুর চামড়া বা তার অর্থ দরিদ্রদের কিংবা মাদ্রাসা বা এতীমখানার দরিদ্র ছাত্রদের দান করা হয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুসলমানদের ন্যায় বাংলাদেশের মুসলমানেরাও যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঈদুল আযহা পালন করে থাকেন। এ সময় মুসলমানরা নতুন পোশাক পরে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি যায় এবং কুশল বিনিময় করে। প্রত্যেক বাড়িতেই উন্নতমানের খাবার প্রস্ত্তত হয়। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও কোথাও কোথাও নিমন্ত্রিত হয়ে এ উৎসবে যোগদান করে। এ উপলক্ষে কয়েকদিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। প্রবাসীদের অধিকাংশই নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঈদ উদযাপন করে। বিভিন্ন মসজিদ-ময়দানে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় কয়েকদিন যাবৎ রেডিও-টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয় এবং পত্র-পত্রিকাসমূহে ইদুল আযহার তাৎপর্য তুলে ধরে মূল্যবান নিবন্ধাদি প্রকাশিত হয়।
লিখেছেন — মোঃ দেলোয়ার হোসেন
715 total views, 1 views today