আইন, বিবেক, নীতির বাতিঘর ও জাতীয় ঐক্যের প্রতিক হিসাবে সকলের প্রিয়জন ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক আর আমাদের মাঝে নেই
ফেসবুকের পাতা ভরে গেছে যার মৃত্যুর সংবাদের অসংখ্য পোস্টে তিনি ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক। আমাদের আইন অঙ্গনের বরেণ্য এই নক্ষত্র গত ২৪ অক্টোবর শনিবার সকালে ৮৫ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। একজন আইনজীবী ও একজন ভালো মানুষ হিসেবে তিনি সকলের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমিও এই ভালো মানুষটির মৃত্যুর সংবাদে শোকাহত। আমি অসুস্থ বিধায় উনার সম্পর্কে দু’টি কথা লিখতে দেরি হলো।
টেলিভিশন টকশো’তে উনার সৎসাহসী স্পষ্টবাদী নিরপেক্ষ বক্তব্য আমাকে ভীষন অনুপ্রাণিত ও আশাবাদী করতো। টেলিভিশন টকশো’ গুলোতে এক সময় তিনি ছিলেন মূল আকর্ষন। মোনাফেকী মানসিকতামুক্ত অন্য রকম উচ্চতার এই ব্যক্তিত্ব সাদা কে সাদা এবং কালো কে কালো বলতেন। নিরবে কাজ করতেন মানুষের জন্য। গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এই প্রিয় মানুষটির প্রতি।
ব্যারিষ্টার রফিক-উল হকের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল, খুব বেশী ঘনিষ্টতা ছিলোনা। তবে এই গুনী মানুষটিকে আমি জানতাম ও বুঝতাম। ২০০৫ সালে এফবিসিসিআই এর এক নির্বাচনী মামলায় উনি আমাদের চেম্বার গ্রুপের হাইকোর্টে মনোনীত আইনজীবী ছিলেন। সেই শুবাদে ২/৩ দিন উনার ল-চেম্বার ও কোর্টে যাতায়াত করেছি। মামলার শুনানীকালে এতো বেশী পড়াশুনা করে যথাসময়ে কোর্টে এতো চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতেন যা সচরাচর অনেক সিনিয়র আইনজীবী অনুসরণ করেন না। তাঁর পেশাগত আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব কে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
“বাংলাদেশের বাস্তবতায় যে কোনো সিনিয়র আইনজীবীর কোনো না কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকে। যে অল্প কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না, রফিক-উল হক ছিলেন তাদের একজন।” দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতির বড়ই প্রয়োজন ছিল। সামাজিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন ও মানব ধর্মের শ্রেষ্টত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
সৎসাহসী, সজ্জন-মানবদরদী, দেশপ্রেমিক, দেশের ক্রান্তিকালে গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ছিলেন বাংলাদেশের আইন অঙ্গনের এক নক্ষত্র। তিনি দেশের অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন। নিজ কর্মগুণেই বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ এই আইনজীবী দেশের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার মৃত্যুতে দেশের আইন অঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক প্রথিতযশা আইনজীবী হিসেবে অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনি বিষয় নিয়ে তিনি আদালতকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। আইনের শাসন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য,অতুলনীয়।
১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে এলএল.বি পাস করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ‘বার অ্যাট ল’ সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালে ইষ্টপাকিস্তান হাই কোর্ট এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে আইন পেশা শুরু করেন। বিভিন্ন সময় তিনি ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন।
বর্ণাঢ্য জীবনে আইন পেশায় দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর পার করেছেন তিনি। বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে আইনি লড়াই করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় বারবারই সোচ্চার ছিলেন রফিক-উল হক। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন বর্ষীয়ান এই আইনজীবী।
১৯৯০ সালের ০৭ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রফিক-উল হক। এ সময়ে তিনি কোন সম্মানী গ্রহণ করেননি। পেশাগত জীবনে তিনি কখনও কোন রাজনৈতিক দল করেননি। তবে নানান সময়ে রাজনীতিবিদরা তাঁকে পাশে পেয়েছেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তাঁর জীবনের উপাজির্ত অর্থের প্রায় সবই মানবতার সেবায় দান করে গেলেন। ১৯৯৫ সালে তিনি সুবর্ণ ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাসহ ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও তার ভূমিকা অপরিসীম। এ ছাড়া ঢাকার আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার পাসপাতালের জন্যেও তিনি বিপুল পরিমান অর্থ দান করেছে। তার স্ত্রী ফরিদা হক (বিবাহ ১৯৬০) পেশায় ডাক্তার ছিলেন। আইন জগতের আইকন চলেই গেলেন। আইনজীবীসহ দেশবাসীর জন্য পথ দেখিয়ে গেলেন। সবাইকে জানালেন শূন্য হাতে এসে শূন্য হাতে যেতে হয়। একজন বিরল গুন সম্পন্ন আদর্শ-আস্থাবান মানুষ হিসাবে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এর বিদায় শূন্যতা সহজে পূরন হবার নয়। তিনি চলে গিয়েছেন কিন্তু রেখে গিয়েছেন পদ চিহ্ন। সেই পথ অনুসরনই হবে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানোর সর্বোত্তম উপায়।
হে মহান স্রস্টা মরহুম ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কে জান্নাত দান করুন। আমিন
—— বীর মুক্তিযোদ্ধা
আলহাজ্ব মোঃ জয়নাল আবেদীন খান
সাবেক এম,পি-৭৩ মেহেরপুর-১
574 total views, 1 views today